বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমছে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে

বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরগতির মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিনিয়োগের নিম্নগতি এবং শিল্পখাতের সংকোচনের ফলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি যোগ হয়ে মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ “ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৪.১ শতাংশে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে যা গত পূর্বাভাসের তুলনায় ১.৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। সাধারণত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে থাকে। ২০২১–২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.১০ শতাংশ, কিন্তু তা ২০২৩–২৪ অর্থবছরে কমে ৫.৮২ শতাংশে নেমে এসেছে।
জিডিপি কমার প্রভাব
জিডিপি প্রবৃদ্ধির হ্রাস অর্থনীতির গতিকে মন্থর করে। কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়, ফলে বেকারত্ব বাড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ কমলে মানুষের আয় বৃদ্ধি সীমিত হয়ে পড়ে। গত তিন বছর ধরে প্রকৃত আয় কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে মানুষের আয় ৮ শতাংশের কিছু বেশি বেড়েছে, তবে মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ঝুঁকি
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বলছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় পাঁচটি ঝুঁকি হলো:
1. উচ্চ মূল্যস্ফীতি: পণ্যের দাম বেড়ে মানুষের জীবনযাত্রায় সংকট তৈরি করছে।
2. চরম আবহাওয়ার প্রভাব: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা ও তাপপ্রবাহ অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
3. দূষণ: বায়ু, পানি ও মাটির দূষণ স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
4. বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব: কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা ও বিনিয়োগের ঘাটতি।
5. অর্থনৈতিক স্থবিরতা: বিনিয়োগ ও উৎপাদন খাতে স্থবিরতা অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বড় আঘাত হেনেছে। পাশাপাশি জ্বালানি সংকট, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন শিল্প খাতকে প্রভাবিত করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখনো দুই অঙ্কে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পিছিয়ে রয়েছে। ভারতে ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমে ৫.২২ শতাংশে নেমেছে। শ্রীলঙ্কায় ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক (-১.৭ শতাংশ) ছিল। পাকিস্তানেও মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে নেমে এসেছে। বিপরীতে, বাংলাদেশে ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০.৮৯ শতাংশ।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ সেলিম রায়হান মনে করেন, বাংলাদেশ সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মুদ্রা ও রাজস্বনীতি গ্রহণ না করায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাবও এর একটি কারণ।

ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
বিশ্বব্যাংক আশা করছে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৪ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংস্কার, এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি এই প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তবে এর জন্য জ্বালানি খাতের স্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন, এবং সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, “সরকারকে বেসরকারি খাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে কাজ করতে হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।”

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। তবে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনৈতিক গতি পুনরুদ্ধার এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করতে কার্যকর নীতিমালা এবং সংস্কার জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *